Lost in Losing

 রাজ্য সরকার যখন হটাৎ করে রাখীর ছুটি ঘোষণা করেন ততক্ষনে সব কিছু হাতের বাইরে বেরিয়ে গেছে। ট্রেনের টিকিট টা টা করতে করতে  এগিয়ে গেছে waiting list 75 এ। দুঃখী মনে বসে থাকি, মনকে প্রবোধ দেই এত ঘন ঘন ঘোরাঘুরি ভালো না। তবু মনটা খচ খচ করে। মহরম আর রাখিপূর্নিমার মাঝে একটি ছুটি মিলে মোট তিনটি ছুটি Roster খাতায় লাল অক্ষরে জ্বল জ্বল করছে। তিনটে দিন অনায়াসে ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেওয়া যায় আবার তিনটে দিনে কত কি এক্সপ্লোরও করা যায়। ভাবতে ভাবতে CCU বাগডোগরা ফ্লাইটের দাম দেখি। মাত্র ছ হাজার। মনের মধ্যে অনেক দ্বন্দ্ব। এই ভাবে তিনটে দিন বাড়িতে বসে কাটিয়ে দেওয়া উচিত? ছোট বেলায় শোনা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের একটি গান মনে পড়ে যায়। ' আয় খুকু আয় '। পাহাড় ঠিক ওভাবেই আমাকে ডেকে যায় ' আয় নীপা আয়'...দোষ আমার নয়, পাহাড়ের। তাই পাহাড় জিতে যায়, আমি দাড়িয়ে দাড়িয়ে হেরে যাই এবং হেরেও জিতে যাই। 

মহরমের দিন night duty করে হসপিটাল থেকেই ট্রলি হাতে সকাল নটা নাগাদ বেড়িয়ে পরি দমদম এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে। সাড়ে বারোটার ফ্লাইট। টাক্সিতে উঠতেই আকাশ অদ্ভুত কান্নাকাটি জুড়ে দেয়।  মনে হয় এরকম আকাশভাঙা বৃষ্টি বহুদিন দেখিনি। Airport এ পৌঁছে কফি খেয়ে একটু গুছিয়ে বসি। এগারোটা পঁয়তাল্লিশ এ বোর্ডিং। ঠিক তার আগেই দুঃসংবাদটি আসে। খারাপ আবহাওয়ার কারণে আমার সাধের ইন্ডিগো ফ্লাইটটি দমদমে আধঘন্টা চক্কর কেটে ফুয়েল শেষ হওয়ার কারণে ভুবনেশ্বর চলে গেছে।

ইন্ডিগোর বেইমানী ও লাউ বিরিয়ানী

_________________________________

বেড়াতে গিয়ে ট্রেনই প্রথম পছন্দ হলেও স্বল্প ছুটির কারণে ফ্লাইটে চড়তে বাধ্য থাকি এবং অন্য কোনো এয়ারলাইনসের থেকে ইন্ডিগো সর্বদা আমার কাছে বেশি গুরুত্ব পায়। আমার বড়ো ভরসার জায়গা ইন্ডিগো। কোনো কারণে ফ্লাইট ক্যান্সেল হলেও কিছু না কিছু ব্যাবস্থা তারা করেই দেয়। এহেন ভরসায় জল ঢেলে ইন্ডিগো জানালো ভুবনেশ্বর থেকে ফ্লাইটটি  ফুয়েল ভরে দমদম ফিরবে এবং চারটে নাগাদ বাগডোগরা উড়ে যাবে, দ্বিতীয় কোনো এয়ারক্রাফট এর ব্যাবস্থা করা গেলনা। এদিকে আমি তিনটি রাত RICU তে কর্তব্য করে ধুঁকছি, ওখানেই বসে প্রতিজ্ঞা করলাম এই ভাবে আর কখনো বেড়াতে যাবনা সে পাহাড় যতই ডাকাডাকি করুক না কেনো।

আমি আমার ড্রাইভার ভাই ও homestay র মালিককে নিজের অবস্থান জানাতেই তারা ভীষন চিন্তিত হয়ে পড়ল। হোমস্টের মালিক একজন ব্যাংকার। তিনি প্রায় পনেরো মিনিট অন্তর আমার খবর নিতে লাগলেন। 

কিছুক্ষন পরেই রিফ্রেশমেন্ট এর ঘোষণা হলো। প্রত্যেকের হাতে একটি করে ভেজ বিরিয়ানীর বাক্স ও আধ লিটার জলের বোতল ধরিয়ে দেওয়া হলো। খাবারের বাক্সটি খুলতেই চক্ষু চরকগাছ। লালচে হলুদ রঙের কাঁচা মশলা দেওয়া ভাতের মধ্যে শোভা পাচ্ছে বিভিন্ন রঙের সবজি। চোখ গেলো একটি সবুজ রঙের ডুমো ডুমো করে কাটা সবজির দিকে। চেখে দেখলাম লাউ। অবশেষে বিরিয়ানিতে লাউ? আর নেওয়া যাচ্ছিলনা কিন্তু ইন্ডিগোর খাদ্য ব্যবস্থাও তথৈবচ। জংলী স্যান্ডউইচ আর soft drink ছাড়া কিছু পাওয়া যায় না।লক্ষ্মীমেয়ের মত লাউ বিরিয়ানী খেয়ে উঠে বসে পড়লাম নিজের জায়গায়।

 পাঁচটা নাগাদ পৌঁছলাম বাগডোগরা । আমার জন্য অপেক্ষমান দীনেশ ভাইয়ের হাতে লাগেজটি তুলে নিশ্চিন্ত হলাম। শিলিগুড়িতে সামান্য জ্যাম পেলেও বাকি রাস্তাটা ভালই কাটল। ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে একটু একটু করে ওপরে উঠছি। সুকনার জঙ্গলের মিলিটারী ক্যাম্প গুলোতে একে একে আলো জ্বলে উঠছে। সাধারণতঃ এই সময় পাহাড় থেকে নেমে আসি। একটু অন্য অভিজ্ঞতা উপভোগ করতে ভালই লাগল। পূর্ণিমা না হলেও অন্ধকারে  কুয়াশা জড়ানো পাহাড় বেশ ভালই ধরা দিচ্ছে। রাতে পাহাড়ের সৌন্দর্য্য বোঝার জন্য এক চিলতে জোছনাই যথেষ্ট।

রংপো পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি রঙলি বাজারের দিকে।আমার এবারের গন্তব্য পাকইয়ংয় সাব ডিভিশনের অন্তর্গত  ছোট্ট অনাঘ্রাতা গ্রাম লসিং। এই গ্রামের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে সুন্দরী রংপোখোলা নদী।

আছে দুয়েকটি হোম স্টে আর উজাড় করা প্রকৃতি। দীনেশ ভাই আমাকে রঙলী বাজার পর্যন্ত নিয়ে এলেন। সেখানে অপেক্ষারত homestay র মালিক বুদ্ধাজী আমাকে স্বাগত জানালেন। ওনার গাড়ীতে সরু রাস্তা বেয়ে আরো সাত কিলোমিটার ভেতরে যাওয়ার পর দেখা মিলল লসিং গ্রামের। 

Homestay তে পৌঁছে আমার কটেজে লাগেজ তুলতে তুলতে বুদ্ধাজী জানালেন ফ্লাইট delay শুনে উনি ধরেই নিয়েছিলেন আমি আজ আর আসবোনা, শিলিগুড়িতে থেকে যাবো। এও জানালেন এই গ্রামে মধ্যরাতে একা মহিলার প্রবেশ এই প্রথম ঘটলো। আমি স্মিত হেসে জানলাম এটা সিকিম বলেই মধ্যরাতে প্রবেশ করেছি বিনা দ্বিধায়। কলকাতা হলে সম্ভব ছিলনা। 

এদিকে আমার নজর চারিদিকের পরিবেশে। আমার কটেজটির ঠিক পাশ দিয়ে কল কল শব্দে বয়ে চলেছে রংপোখোলা। আমি ক্লান্ত তবু চারিদিকের এই মায়াবী পরিবেশ দেখে মনে হলো আরে এই জন্যই তো এত রাতে এত দুর থেকে ছুটে আসা। শুধু এইটুকু পাবো বলেই তো এত যুদ্ধ। গরম গরম ডিনার পরিবেশিত হলো নদীর পাড়ের ছোট্ট টেবিলে। খাওয়ার বিশাল ব্যাবস্থা থাকলেও আমি বেছে নিলাম  বাম্বু শুট কারি, দেশী মুরগী কষা, পেয়াঁজ, টমেটো , ডলে লঙ্কার চাটনি ও গরম ভাত। পরম তৃপ্তিতে খেয়ে যখন শুতে গেলাম, মনে হলো নদীর এই কুল কুল শব্দ পৃথিবীর কোনো sedation মিউজিককে সাত গোলে হারিয়ে দিতে পারে। এই পরিবেশটি পাওয়ার জন্য যে কোনো মুল্যই কম পড়ে। আজ কোনো অ্যালার্ম দেওয়ার প্রয়োজন দেখিনা। এই দেড়টা দিন শুধু আমার। চোখ জুড়িয়ে আসার আগে ঘড়ির দিকে তাকালাম। তখন রাত একটা।

ভালো থাকুন, ভালো রাখুন।



















Previous Post Next Post

Contact Form