মাসাইমারার গপ্পো
আমার প্রিয় শখ দিবাস্বপ্ন বুনন, শুধুমাত্র স্বপ্ন দেখেই আমি ভীষণ খুশি রাখতে পারি নিজেকে এবং স্বপ্নের বুননে এতটাই পসিটিভিটি থাকে , মনে হয় একদিন যে পূরণ হবেই, তা নিয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। স্বপ্নের লিস্ট লম্বা। কিছু পূরণ হয়েছে....তবে অনেকটাই বাকি। আলাস্কা, নরওয়ে, গ্রীন ল্যান্ড, আইসল্যান্ড..... স্বপ্নের ভিড় প্রচুর । দেশেরগুলো মোটামুটি মেরে আনতে পারলেও বিদেশ পুরোটাই অধরা ( নেপাল, ভুটান বা সিকিমকে বিদেশ না ধরে বলছি) করোনার তিনটি বছরে আমার স্বপ্নের গতি বেড়ে গেছিলো অনেক গুণ। Duty থেকে ফিরে you tube আর গুগলের মাধ্যমে স্বপ্ন রচনা শুরু হতো।
আমার বেডরুম দখল করে রয়েছে দুটি বড়ো সাদা চার্ট পেপার। একটিতে দেশের ও অন্যটিতে বিদেশে বেড়াবার স্বপ্নজাল বোনা। দেশেরটিতে প্রচুর লাল কালির টিক মার্ক , তবে অন্যটিতে এখনও পড়েনি তাই এবার একটু সিরিয়াস হয়ে উঠলাম। এক্ষুনি এক্ষুনি যদি শুরু না করি ... পৃথিবীর এত গুলো দুধ্বর্ষ ল্যান্ডস্কেপ আর natural ওয়ান্ডার্স কবে দেখবো? ( আমার দৃর বিশ্বাস মৃত্যুর আগের মুহুর্ত পর্যন্ত বেড়াবো) আমার পরিবার আরো সিরিয়াস মুখে আমার দেওয়ালে আটকানো এই ট্রাভেল প্ল্যানের দিকে চেয়ে থাকে আর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে। মৃত্যুর আগেই যে নিজের রোজগারের সব টাকা খরচা করে তবেই মরবো তাতে কোনো সন্দেহ নেই এইটুকু স্পষ্ট বোঝা যায়। আমার এই দিবাস্বপ্ন নিয়ে প্রচুর হাসাহাসি হয় আমার পরিবার ও বন্ধুমহলেও। তবে এখন অনেকেই মেনে নিয়েছে যে ঠিকঠাক স্বপ্ন বুনতে পারলে তার কিছুটা হয়তো সফল হয়েই যায়। ওই যে কি একটা সিনেমাতে শাহরুখ খান বলেছিলেন " কিসি চিজ ক আগের দিলসে চাহ তো পুরি কায়ানাত...." ইত্যাদি ইত্যাদি আমারও এই দীর্ঘ পাঁচবছর ভ্রামনিক হিসেবে এটাই উপলব্ধি যা কিছু আমরা মন থেকে চাই...যদি সে চাওয়ায় একশো শতাংশ পজিটিভ থাকি, ..... পুরো প্রকৃতির ষড়যন্ত্র রচনা করে সেই সপ্নকে বাস্তবে মিলিয়ে দেওয়ার...শর্ত একটাই...এক পার্সেন্ট ও নেগেটিভ হওয়া যাবেনা।
Wild beast great migration র উপলব্ধি শুরু ক্লাস এইট থেকে। National জিওগ্রাফি চ্যানেল এ গ্রেট মাইগ্রেশন বড়ো বড়ো চোখ করে গিলতাম আর ভাবতাম উপরওয়ালার তৈরি এই আশ্চর্য চিড়িয়াখানায় সবাই কি সুন্দর স্বাধীন। আর বোকা মাথামোটা বিস্টগুলো সব বুঝে শুনেও কেনো বেরোয় অ্যানুয়াল মাইগ্রেশন। অনেক পরে বোঝেছি... নিয়তি আর সময়...এর ওপরে কেউ নয়। যাইহোক ওটা দেখার পর প্রতি বছর শীতকালে নিয়ম করে বাবার হাত ধরে ,কমলালেবু নিয়ে, আলিপুর চিড়িয়াখানা যাওয়াটা ছেড়ে দিলাম কারণ আমার নিশ্চিন্ত বিশ্বাস জীবনে একদিন আমি masaimara যাবই আর পৃথিবীর সবচেয়ে বড় চিড়িয়াখানায় সব পাবো।
এরপর কেটে গেছে বহুকাল। একা একা বেড়াই...দেশের বিভিন্ন national পার্কে। গরূমারা, জলদাপারা, চিলাপাতা থেকে বন্দিপুর, দাচিগাম, মুদুমালাই বা মাসান গুড়ি। জিম করবেট, পেরিয়ার বা তাডোবা কিছুই বাদ নেই। সব জায়গায় টুরিস্টরা ক্যামেরা দাগিয়ে বসে থাকলেও তেনাদের দেখা নেই। প্রত্যেকটা সাফারির শেষে দীর্ঘনিশ্বাস। সেই সময় আমি নিশ্চিন্ত মনে বসে জঙ্গল অনুভব করতাম। জঙ্গলের নিস্তব্ধতা, ঝি ঝি গান, কিছু অজানা অদ্ভুত শব্দ মাতাল করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট আর সেই অজানা শব্দের মোহে কতবার যে ড্রাইভার ভাইদের এক্সট্রা পয়সা দিয়ে মাঝরাতে জঙ্গলে গিয়ে গাড়ির লাইট অফ করে বসে থেকেছি তার ইয়াত্তা নেই। যদি সাথে হালকা বৃষ্টি থাকে তাহলেতো কথাই নেই, মাদকতা চরমে পৌঁছায়।
আমার এই গভীর জঙ্গলের একা রোমহর্ষক রাত্রি যাপন , মিশকালো অন্ধকারের গন্ধ নেওয়া, পূর্ণিমা রাত্রে হলং এ জানোয়ারদের জল খেতে আসার অপেক্ষা সবই যেনো লাইফ span বাড়াতে সাহায্য করে। তবে জন্তু দেখতে না পেলে কোনোদিনই আফসোস হয়নি আমার কারণ আমি তখন জঙ্গলের উন্মাদনায় মত্ত। আরো মনে নিশ্চিন্ত বিশ্বাস একদিন তো masaimara যাবোই আর সব দেখে নেবো। আমার এই প্ল্যানটা আমার প্রায় সব ড্রাইভার ভাইই জানতেন। যদিও তারা এটা জানতেন না Masaimara কদ্দুর? প্রথমে জন্তু জানোয়ার না দেখতে পাওয়ার জন্য সান্তনা দিলেও পরে আমার মস্তিষ্কের সুস্থতা সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা পেয়ে চুপ করে যেতেন। সব সময় মনে হতো আপাতত জঙ্গলটা উপভোগ করি। বাঘ সিংহ নাই বা পেলাম, ঘন জঙ্গলের বন্যতাও তো কম উত্তেজক নয়। বিশেষ করে বর্ষার শেষে সেপ্টেম্বর মাসে রাইডাক, মেদলা বা বক্সার মত ঘনও জঙ্গল ভয়ঙ্কর সুন্দর হয়ে ওঠে।
তবে স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দিতে গিয়ে বেশ কিছু ধাক্কা খেলাম।
যার পরিবার বেড়াতে ভালোবাসেনা, অর্থাৎ একা বেড়াতে হয় তার চাপ প্রচুর।একে প্রথম বিদেশ ভ্রমন তারপর অঙ্কে PHD, টাকা পয়সার হিসেবটা শেষমেশ করে উঠতে পারবো কিনা সেই নিয়ে মাথা যন্ত্রণার শুরু। সেই সঙ্গে শুভাকাঙ্ক্ষী বন্ধুদের অজস্র জ্ঞান....ওখানকার মানুষজন কুমির খায়, ছিনতাই হয়, খেতে পাবিনা অথবা সিংহের খাদ্য হবি ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে ভ্রমণ গ্রপগুলির post আমাকে অনেকাংশে এগিয়ে নিয়ে গেছে।
আমি সাধারণ সরকারী চাকুরে, সাথে মধ্যবিত্ত মন। প্রথমেই ভেবে ছিলাম প্রতিবারের মত একাই যাবো। স্বপ্নভঙ্গ হলো যখন দেখলাম masaimara ই প্রতিদিন land cruiser ভাড়া আকাশ ছোঁয়া মূল্য। একা বেড়াতে গেলে যে একটি কিডনি আফ্রিকায় দান করে আস তে হবে তাতে কোনো সন্দেহ রইলনা।
বেড়াবার জন্য যে পিএফ হাত দেয় তাকে সবাই নিখুঁত মূর্খ ছাড়া কিছু ভাবেনা। আমাকেও সবাই তাই ভেবেছে। সুতরাং একই সাথে প্রচুর উপদেশ এবং গালাগাল প্রাপ্তিও কম চাপের নয়। তবে বেড়িয়ে আসার মনে হয়েছে চালাক হয়ে কাজ নেই ভাই ... আমার মূর্খামি বেচেঁ থাকুক।
যেদিন শুনলাম এক লিটার জলের দাম
সাড়ে চারশো থেকে পাঁচশো টাকা সেদিন বুকের বাঁদিক একটু কেঁপে উঠেছিল।
আরো একবার কেঁপে উঠেছিল যখন NRI ব্রাঞ্চ এ গেলাম ডলার কিনতে। আমি বাপু সাধারণ সাধারণ সরকারী কর্মচারী.... হাতে পাঁচটি পাতলা পাতলা 100 ডলার ধরিয়ে যখন দুম করে কেটে নিল চল্লিশটি হাজার টাকা.... বেজার মুখে ঘরে ফিরে ছিলাম।
এই বিস্তর কাঁপতে কাঁপতে আফ্রিকান based বাঙালি টুর অপারেটরের সাহায্যে একটি সিনিয়র সিটিজেন দের ছোট গ্রুপে ঢুকে পড়লাম। তাদের বয়স যথাক্রমে চুরাশি, পঁচাত্তর ও তিশট্টি। সেখানে আমিই সর্বকনিষ্ঠ। গ্রুপটি বড়ই ছিল কিন্তু কোনো কারণে ভেঙে গিয়েছিল। এনাদের দেখে ভরসাও বাড়লো। তবে যাই... এই বেলা সিংহের সাথে মোলাকাতটা সেরেই আসি।
পরিবারকে বোঝাতে যেতেই তাদের অদ্ভুত প্রশ্নবানে জর্জরিত হলাম। " গরামারা দেখার পর masaimara র কি প্রয়োজন?'
অর্থাৎ কিনা পুরী দেখার পর লাক্ষাদীপ দেখার কারণ জানতে চাওয়া জনগণকে বহুকষ্টে আফ্রিকার আশ্চর্য বন্যপ্রাণ তাই নিয়ে আমার চরম উত্তেজনা বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলাম।
Jokes apart যদি masaimara নিজেরা বেড়াবার প্ল্যান করেন তবে মাথায় রাখবেন একটি ল্যান্ড ক্রুজার এ ছজন মানুষ উঠতে পরে , ছোট দল বা কাপল হলে খরচা বেশি।
সলো ট্রাভেলার দেখিনি এমন নয়। আলাপ ও হয়েছে তবে কিনা তারা একজন হল্যান্ড ও অন্যজন কলেরাডো এর বাসিন্দা .... ডলারে বা পাউন্ডে রোজগার করেন আর কেনিয়ান সিলিংয়ে যার বেড়াছেন যায় মূল্য টাকার থেকেও কম। টাকায় রোজগার করে ডলারে বেড়ানো বেশ চাপের তাই একা নৈব নৈব চ।
wild beasts great migration এর সময় জুলাই থেকে অক্টোবর। এই সময় যেতে হলে আগে থেকে নাইরোবির টিকিট কাটুন।
কেনিয়া airways বা এমিরেটস খুবই ভালো হলেও দামটা কিন্তু বড্ডো ভালো। Air India সস্তায় পুষ্টিকর। যদিও ক্যান্সেল হয় প্রচুর। তবুও সময়ের আগে পৌঁছে দেওয়ার বিস্তর উদাহরণ আছে।
কেনিয়ার বন্যপ্রাণ মূলত গ্রেট রিফট valley, কিছু lake, সাভানা অর্থাৎ তৃণভূমি আর কিছু মাউন্টেন range নিয়ে গঠিত। আমরা প্রথমে great rift valley and lake side করে তারপর সাভানার দিকে গেছিলাম। আফ্রিকার বন্যপ্রাণ নিয়ে এত লেখা পাওয়া যায় কিন্তু মাউন্ট কিলিমাঞ্জারো ছাড়া ল্যান্ডস্কেপ নিয়ে তেমন কিছু পাইনা। এই অঞ্চলের দূষণ মুক্ত, দুর্দান্ত ল্যান্ডস্কেপও কিছু মাত্র পিছিয়ে নেই।
Masaimara নিয়ে বহু পোস্ট আছে, এবং যেহেতু একটা সংস্থার মাধ্যমে গিয়েছিলাম , এখানে উপভোগ করা ছাড়া কোনো বিশেষ কৃতিত্ব নেই আমার তাই বিস্তারিত ভ্রমন বৃত্তান্তে না গিয়ে বরং মাসাইদের ছোট ছোট গল্প নিয়ে ফিরি। আর হ্যা...দীর্ঘ পাঁচ বছর পর ছোট গ্রুপ যা কিনা ফ্যামিলির মতোই ছিল.... ঘুরে মনে হয়েছে একা বেড়ানোর কোনো জুড়ি নেই। একা বেরালে হয়তো আরো বেশি নিজের মত করে এক্সপ্লোর করতে পারতাম তবে সাধ আর সাধ্যেকে একই সূত্রে বাঁধা সব সময় সম্ভব হয় না তাই কিছুটা ছাড়তে হয়।
ভালো থাকুন। ভালো রাখুন।
চাইলে আমার আরো একক ভ্রমণের গল্প পড়তে পারেন এই ঠিকানায়
Made By Rishav Das