দামসং valley ও বার্মেক
------------------------------------
পূর্ণিমায় তুষার আচ্ছাদিত কাঞ্চনজঙ্ঘা শুধু আমি না প্রায় সব বাঙ্গালীরই প্রথম প্রেম। তারসাথে যদি পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণ যুক্ত হয় তাহলে একেবারে শনির সাড়ে স্বাতী লাগার উপক্রম। এই সময় কাঞ্চনজঙ্ঘার আশেপাশে যাওয়ার চেষ্টাও দুঃসাহসের নামান্তর। আমি, পূর্ণিমা ও কাঞ্চনজঙ্ঘা এই সেরা সংমিশ্রনটি যখনই তৈরি করার চেষ্টা করিনা কেনো সর্বদা বিফল মনোরথে ফিরতে হয়। ভরা পূর্ণিমায় দার্জিলিং, কালিম্পং বা সিকিম যে অ্যাঙ্গেল থেকেই কাঞ্চনকে ধরার চেষ্টা করিনা কেনো তিনি দেখে দেখে ঠিক সেই জায়গায় কোনো অজানা কারণে মুখলোকান মেঘের আড়ালে। অথচ পূর্নিমার দুতিন আগু পিছু হলেই তিনি সুন্দর দাঁত বার করে আসছেন? তাহলে পূর্ণিমা কেনো নয়? এর অনুসন্ধান করতে রাস পূর্ণিমাকে বাছলাম যদিও মনে ছিলনা এই দিনটি পুর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণও বটে সুতরাং নর্থ বেঙ্গলের ট্রেন টিকিটের প্রতিযোগিতা তিনগুণ।
সুতরাং 15 দিন আগে চেষ্টা করেও ওয়েটিং লিস্ট ওয়ান থেকে যখন টিকিটের কোনো নরণ চরণ নেই বাধ্য হয়েই শ্যামলীতে দুলতে দুলতে কোমরটি হাতে নিয়ে শিলিগুড়ি পৌঁছনো , সেখান থেকে একটি অটোতে পানিট্যাংকি মোড়, সেখান থেকে একটি বাসের দুটি সিট বুক করে সোজা কালিম্পং, মাত্র তিনদিনের ছুটি এবং প্রায় পরিকল্পনাহীন যাত্রায় কাঞ্চনজঙ্ঘাকে ধরার এর থেকে কাছাকাছি অন্যকোনো পার্বত্য শহর আমার মনে পড়লোনা।
কালিম্পং বাস স্ট্যান্ড থেকে 1200 টাকা দিয়ে একটি টাক্সি বুক করে চলে এলাম বার্মিওক এর অনুগ্রহ হোমস্টে (8910953917) । বাহুল্য বর্জিত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এই আশ্রয়টি একদমই বিলাসিতার অনুপযোগী। তাহলে আমি এই হোমস্টে বাছলাম কেনো? বেশি কিছুনা...শুধু মাত্র দিনের বেলা ঘর ও ব্যালকনি থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা ১৮০ ডিগ্রীতে ধরা দেন। , এছাড়া রাতে ব্যালকনিতে দাড়ালে উল্টোদিকে দার্জিলিং ও সিকিম এর পাহাড়গুলি ঝকঝকে আলোকমালায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সামান্য এইটুকু পাওনায় যদি কেউ সন্তুষ্ট থাকেন তবে আসতেই পারেন দারাগাও বা বার্মিওকে। তবে মাথায় রাখবেন আমি একা ঘুরি, পাহাড় পাগল সেই হিসেবে এই ধরনের থাকার জায়গা আমার নিখুঁত বলে মনে হলেও, আপনি যখন পরিবার নিয়ে আসবেন , বিষয়টি নিয়ে ভাবনা চিন্তার প্রয়োজন আছে।
এছাড়া রয়েছে সুশিতা তামাংয়ের হাতের রান্না খাবার উপভোগ করার সুযোগ। বিশেষ করে সন্ধেবেলায় ভেজ মোমোর সাথে সাদা তিলের চাটনি বেশ উপভোগ্য। রাতের খাবারেও চমক ,তিল বাটা দিয়ে ঢেঁড়সের ফ্রাই, চিকেন ফেলে ওটাই বেশি উপভোগ করেছি। আর একটা রহস্য আমি কিছুতেই ভেদ করতে পারিনা ... স্কোয়াশের তরকারি এত যত্নের করে বাড়িতে রান্না করলেও এত সুস্বাদু কেনো হয়না? আর সামান্য বাঁধাকপি বা স্কোয়াশ দিয়ে বানানো ভেজ মোমোই বা মুখে দিলে গলে যায় কি করে?
হোমস্টে থেকে ছোট্ট হাইকিং করে পৌঁছে যাওয়া যায় জলসা বাংলো এবং হিমালয়ান পার্ক ভিউ পয়েন্ট। এই হিমালয়ান পার্ক ভিউ পয়েন্ট থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা সমেত আশেপাশের পাহাড় গুলির 360 ডিগ্রী। এছাড়া জলসা বাংলো ভিউ পয়েন্ট ও দারুন, বিশেষত গাছবাড়ি গুলি। এছাড়া পেয়ে হেঁটে ছোট্ট গ্রামটাও ঘুরে দেখতে বেশ লাগে।
এরপর সন্ধের অপেক্ষা। আমার ইচ্ছেকে দুয়ো দিয়ে চাঁদ উঠলনা, কাঞ্চনদা ধরা দিলনা, শুধু দুর থেকে দার্জিলিং ও সিকিমের পাহাড়গুলি থেকে জোনাকির মত আলোকমালা আমার দিকে তাকিয়ে ফিক ফিক করে হাসতে থাকলো , আর পরদিন ভোরবেলা চোখ খুলতেই বিছানা থেকে আকাশ জুড়ে কাঞ্চন দৃষ্ট হলো।
বিশেষ ধন্যবাদ বন্ধু pinky Ghosh যার সাহায্য ছাড়া এরকম একটি জায়গার সন্ধান পাওয়া দুষ্কর ছিল। যখনই অসময়ে মন পাহাড় পাহাড় করে...ট্রেনের টিকিট বা থাকার জায়গা পাওয়া যায়না... .তখনই আমি এনাকে স্মরণ করি, উনিই রক্ষা করেন।
পরদিন বাসা বদলাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। ভ্রমণ গ্রুপগুলিতে চিরুণী তল্লাশী করে বার করলাম দামসং valley র Newhang homestay ( 9123775044). পরদিন ট্যাক্সীতে ( এম. ছেত্রী 8972964637) 500 টাকার বিনিময়ে বারমেক থেকে পৌঁছলাম আপার পেডং এর দামসাং valley. অন্দরে প্রবেশ করতেই মন খুশী, সামনেই অসাধারণ পাহাড় ও জঙ্গলের দৃশ্য সেই সঙ্গে সামান্য বাদ দিকে থেকে উঁকি দিচ্ছেন কাঞ্চনজঙ্ঘা। ব্যালকনি ও ডাইনিং এর অবস্থান অসামান্য। হোস্ট কলকাতা নিবাসী অসীমদার জানতে চাইলেন আমি কি খেতে চাই? আমি একটু থমকালাম এর আগে এরকম প্রশ্ন শুনিনি, মোটামুটি হোমস্টেগুলিতে একই রকম খাবার দেওয়ার নিয়ম , বাইনাক্কা চলেনা, এটাই দস্তুর। যাইহোক আমি যে মধুমেহ রোগের শিকার এইটুকুই জানিয়ে ছিলাম। এরপর চারটি মিলই ছিল অসাধারণ । হালকা অথচ সুস্বাদু খাবার আমার রসনার তৃপ্তিতে দুর্দান্ত সাহায্য করেছিল। কিছু ডিস যেমন কাঠের আগুনে পোড়ানো বেগুন ও টমেটোর ভর্তা, চিজ মোমো, স্কোয়াশ পাতায় মরা শিদল , ধনেপাতা ও বড়ি দিয়ে হালকা মাছের ঝোল সবই অসাধারণ এবং রান্নার দায়িত্বটি অসীমদা কাউকে ছাড়েন না, দেখলাম নিজেই সকাল থেকে লেগে পড়েছেন।
কিছুদিন ধরে বিভিন্ন ট্রাভেল গ্রুপে পড়ি বাঙালিরা পাহাড়ের হোমস্টে গুলির লিজ নিয়ে সর্বনাশ করেছে। এই তথ্য অনেকাংশে ঠিক হলেও আমি অনেক হোমস্টেতে থাকার অভিজ্ঞতা নিয়েই বলছি এরকম অতিথি সৎকার আমি নেপালি না সিকিমিস দের মধ্যেও পাইনি। এখন বুঝি এইভাবে তুলনা করা ভুল। মানুষ দু প্রকার... ভালো ও খারাপ। বাঙ্গালী, নেপালি, সিকিমিস এই প্রকার ভেদে মানুষকে না দেখাই ভালো।
সুন্দরী Damsang এর রাস্তা অসাধারণ । এরকম পরিষ্কার রাস্তা হওয়ার কারণ জানা গেলো এই অঞ্চলটি রক্ষণাবেক্ষ্মণ করেন মিলিটারিরা। এছাড়া রাস্তার দু ধারে অজস্র ফুলের সমাহার দেখে এটিকে কালিম্পং এর valley of flowers বলা টাও ভুল হবেনা বোধহয়। ছবি দেখে আপনারাই না হয় ঠিক করুন। একটু হাইকিং করলে পাওয়া যায় damsang ফোর্টের ধ্বংসাবশেস।
সন্ধেবেলা পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণ কাটতেই পূর্ণিমায় গোটা পাহাড় রূপালী আলোর বন্যায় ভেসে গেলো। 15 ডিগ্রী ঠান্ডায় নিজেকে কম্বলে মুড়ে, মুখ চালাতে চালাতে পুরো সন্ধ্যাটি চাঁদের আলোয় ভিজে, ওখানেই নৈশাহারটি সেরা বিছানায় গমন, রাত তখন দুটো ।