ফ্লাইট ক্যানসেলেশনের সাইড এফেক্ট
---------------------------------------------
" জগতে শুধু এলেই তো হল না, সে তো সবাই আসে। আনন্দযজ্ঞের খোঁজটি পাওয়া চাই, সেটা সবাই পায় না......। আমি বড় চঞ্চল। বড় অস্থির। কখনো এস্পার, আবার কখনো ওস্পার। এই ছিলুম ঘরে, এই বসেছি পারে। আর ভেতরে ভেতরে? না ঘরের, না পারের, স্রেফ পারাপারের সওয়ারি।"
নবনীতা দেবসেন।
বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কারণে আমার ভ্রমণ বিঘ্নিত হয়েছে, কখনো বা পথ পাল্টেছে, ভ্রমণের শুরুতে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছি অথবা নির্দিষ্ট সময়ের আগে বা পরে ফিরতে বাধ্য হয়েছি। প্রথম দিকে সামান্য উৎকন্ঠা প্রকাশ করলেও দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় বুঝেছি এ পৃথিবীতে সবই পূর্ব পরিকল্পিত, যতই প্ল্যান করে চলি না কেনো উপরওয়ালার মত বড়ো প্ল্যানার কেউ নেই। তাই জল যেদিকে গড়িয়েছে আমি সেদিকেই ভেসেছি এবং দিনের শেষে লাভবানই হয়েছি। " যাহা পাই তাহা ভুল করে" মোটেই পাই না .... বরং কপালে নাচছিল তাই পাই...এটাই আমার বিশ্বাস।
একটু বুঝিয়ে বলি একবার লেহ থেকে শ্রীনগর আসার পথে পাহাড়ে বিশাল ধসের সম্মুখীন হয়েছিলাম। সেই সময় ওখানে জোজিলা টানেল তৈরি হচ্ছিল। সকাল এগারোটা থেকে বিকেল চারটে অবধি রাস্তা বন্ধ ছিল। প্রথমে খুব মন খারাপ হলেও পরে বাধ্য হয়ে যোজিলার অজানা দিক গুলির রস নিতে পেরেছিলাম।সেই বার যেভাবে জোজিলার বন্য রূপ অন্বেষণ করার সুযোগ হয়েছিল তাতে করে আমার উপলব্ধি রাস্তা বন্ধ না থাকলে কখনোই আমরা সেই ভাবে স্বাদ নিতে পারতাম না।
এই অক্টোবর মাসে লক্ষ্মীপুজোর সময় আমি তাওয়াং যাওয়ার প্ল্যান করেছিলাম। পারিবারিক সমস্যা থাকায় বেড়ানো ভেস্তে গিয়েছিলো বলে খুবই মন খারাপ করে বসে ছিলাম। পরে জানলাম দিরাং ভালুকপং রাস্তায় বিরাট ধস নেমে রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছিলো, বৃষ্টি ছিল যথেষ্ট এবং ভ্রমনার্থিরা বেশ অসুবিধায় পড়েছিলেন। তাই এই
" উপরওয়ালা" র প্ল্যান ওপর আমার বড়ো ভরসা, জীবনে তো " কিছুই যায় না ফেলা" হয় লাভবান হই অথবা শিক্ষা নেই... তাই একে লোকসান বা ভোগান্তি না ভাবাই ভালো।
সম্প্রতি আরও একবার " উপরওয়ালার ষড়যন্ত্রে " কিভাবে বেড়াতে বেড়িয়ে বোনাস নিয়ে ফিরলাম সেটা জানাতেই এত গৌরচন্দ্রিকা।
আমি বাজেট ট্রাভেলার, তাই কেনিয়া ভ্রমণের জন্য কেনিয়ান এয়ারলাইনস বা এমিরেটস নয় বেছে নিয়েছিলাম এয়ার ইন্ডিয়া। ডাইরেক্ট ফ্লাইট ছিলনা , ভায়া আমেদাবাদ ও দিল্লী এবং প্রায় দুঘন্টা বেশি সময় নেয় পৌঁছতে তবু সস্তায় পুষ্টিকর হিসেবে এর বিকল্প নেই। ফেরার দিন একটু মন খারাপ হয়ে গেছিলো কারণ national পার্ক আর লেকগুলি দেখতে গিয়ে নাইরোবি শহরটি সেই ভাবে এক্সপ্লোর করা হইনি।
এয়ারপোর্ট পৌঁছতে জানা গেলো এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট ক্যান্সেল হয়েছে এবং পরের দিন একই সময়ে ফ্লাইট ছাড়বে। ঘোষণা শোনার পর যাত্রীদের মধ্যে বিশেষত গুজরাটি যাত্রীদের মধ্যে বিরক্তি লক্ষ্য করা গেলো। আর বিনাপয়সায় একদিন এক্সট্রা নাইরোবি থাকাটা আমার ক্ষেত্রে শাপে বর হলো।
এরপর আর কি? এয়ার ইন্ডিয়ার বাসে করে এক ফাইভ স্টার হোটেলে পৌঁছলাম এবং একদিন অতিরিক্ত বাস করার সুযোগ পেয়ে আহ্লাদে আটখানা অবস্থা। হোটেলটি অসাধারণ ছিল ফলতঃ দুর্দান্ত একটি সূর্যোদয়ের সাক্ষী থাকা এবং বেশ উচুঁ থেকে নাইরোবি শহর দর্শন সেই সঙ্গে ফাইভ স্টার হোটেলের সুইমিং পুল, sauna, স্পা ইত্যাদি কমপ্লিমেন্টারি সার্ভিসের আনন্দ নেওয়া। গত ন দিন ধরে আধসেদ্ধ পুষ্টিকর খাবার খেয়ে স্বাদযন্ত্রের করোকগুলি বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল। দুপুরের খাবারে আলু বেগুন কুমড়োর তরকারি পেয়ে এমন উৎফুল্ল হয়ে উঠবো কোনোদিন ভাবিনি। সর্বোপরি যখন 500 টাকা লিটার জল ফ্রীতে পাওয়া যায় এর থেকে আনন্দের আর কি হতে পারে?
সাঁতার, সওনা , স্পা আরও চারটি যন্তর মন্তর ঘেঁটে, সকলের আগে লাঞ্চটি সেরে শহর দেখার তাল করতে লাগলাম। নিচে অ্যাপ ক্যাব এর জন্য তথ্য সংগ্রহে গিয়ে চমকে উঠতে হলো। এক থেকে দেড় কিলোমিটার যাত্রার মূল্য কমপক্ষে দশ ডলার। বিষন্ন বদনে ঘরে ফিরে আসার চেষ্টা করতেই রিসেপশনিস্ট দাদা এগিয়ে এলেন।জানালেন এখানে hitchhiking বেশ জনপ্রিয় সুতরাং আমি চেষ্টা করতেই পারি।
অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় আমার উৎসাহ তখন দ্বিগুণ। কারণ বাজেট ট্রাভেলারদের জন্য hitchhiking এর কোনো বিকল্প হতে পারে না এবং আমার দেশে একা মহিলার hichhiking প্রায় অসম্ভব বা অসুরক্ষিত তাই এই ইচ্ছাটি মনের মধ্যেই দমন করা ছিল। এত দিন পর সেই স্বাদ নেওয়ার সুযোগ পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে হলো।
আমি নতুন শহর এক্সপ্লোর করতে ভীষণ ভালোবাসি। মুলত বসতির ধরন, অজানা মডেলের গাড়ি, স্থানীয় মানুষ এবং স্থানীয় খাবার গুলি সম্পর্কে ধারণা তৈরি করার উদ্দেশ্যেই এই অ্যাডভেঞ্চার। আমি হোটেল পারিনিতে ছিলাম যা national হাইওয়ের একদম ওপরে। কিছুক্ষনের চেষ্টায় আমি একটি গাড়ির চালককে মোটামুটি বুঝিয়ে পাড়ি দিলাম এবং ঘণ্টা আড়াইয়ের মধ্যে দুটি মল ও একটা পার্ক এক্সপ্লোর করেছি।
প্রায় বায়ু ও শব্দদূষণহীন নাইরোবি যা কিনা
" Green city of sun " নামে বিখ্যাত আমার বেশ লেগেছে। শহরে হাই রাইস প্রায় দেখাই যায়না এবং প্রচুর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। যে কজন মানুষের সাথে পরিচয় হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে প্রত্যেকে বেশ বিনয়ী , হেল্পফুল এবং ফ্রেন্ডলী।
একটা ছোট উদাহরণ হিসেবে বলি আনন্দে আত্নহারা হয়ে অতিরিক্ত শপিং এর কারণে আমার একটি ট্রলি ব্যাগ কেনার প্রয়োজন পড়েছিল। যিনি আমাকে ড্রাইভ করে মলে ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনিই আমাকে যথেষ্ট তথ্য দিলেন যে কোন জায়গা থেকে কিনলে সুবিধা হবে। কেনার পর ডলারে পেমেন্ট করতে গিয়ে দেখলাম ব্যালান্স হিসেবে কেনিয়ান সিলিং দিচ্ছেন । এদিকে কলকাতায় কেনিয়ান সিলিংকে ডলারে বিনিময় বেশ চাপের, নাইরোবি এয়ারপোর্ট এ চেঞ্জ করতে হবে। এয়ারপোর্ট এ এই ফালতু ঝামেলা আমি নিতে চাইছিলাম না তাই ট্রলি না কিনেই ফিরছিলাম। ওদেরই মধ্যে একজন স্টাফ আমাকে অন্য একটি শপে এ নিয়ে গিয়ে শিলিংকে ডলারে ট্রান্সফার করে দিলো কোনো স্বার্থ ছাড়াই। তাতে করে তার প্রায় আধঘন্টা অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছিল। এই ঘটনা বেশ করেছিল অবাক করেছিল আমাকে। আমরা সংক্ষিপ্ত প্রকৃতির মানুষ। কেউ তথ্য চাইলে উত্তর দিয়ে দায় সারি। এ বেশি আগ্রহ সাধারণত দেখাই না। ওই দিন যারা আমাকে বিভিন্ন গন্তব্যে ছেড়ে ছিলেন তাদের আগ্রহ ছিল দেখার মত। কোন দেশ থেকে এসেছি? কি দেখলাম ? আবার কবে আসবো, কি কি বাদ থেকে গেলো, হাজারো প্রশ্নে হারিয়ে যেতে বেশ লাগছিল আমার, কারণ স্থানীয় মানুষদের সাথে গল্প করা আমার ভ্রমণের অত্যন্ত প্রিয় একটি দিক।
নাইরোবির নাইট লাইফ অত্যন্ত চমকপ্রদ হলেও অজানা শহরে একা উপভোগ করাটা সমীচীন মনে হয় নি তাই সন্ধ্যে নামার আগেই ফিরে এসেছিলাম হোটেলে। এছাড়া যাওয়ার আগে হোটেলের রেস্টুরেন্টে প্রচুর অফার লক্ষ্য করেছি। ফিরে ফ্রেশ হয়ে প্রিয় পানীয়টি নিয়ে যে অসাধারণ সূর্যাস্তের সাক্ষী থাকলাম সেই মুহূর্তটি বর্ণনার ভাষা নেই। যাকে বলে " জন্ম জন্মান্তরে ও ভুলিবোনা"।
যে দুঃখ ভোলার নয়.... হোটেলে ফিরে এসে ওই একই ফ্লাইটের অল্প পরিচিত দুচারজন বয়োজ্যেষ্ঠ বাঙালি মহিলাদের প্রচন্ড উৎসাহ নিয়ে গল্প বলতে গিয়ে ভয়ঙ্কর বকাঝকার মুখোমুখি হতে হয়েছে। তাদের বক্তব্য খানিকটা এরকম.... Hichhiking? এত দুঃসাহস?একটা দুর্ঘটনা ঘটা অসম্ভব ছিলনা...সেই সঙ্গে পরেরদিন নাইরোবি এবং দেশের প্রত্যেকটি খবরের কাগজে আমার ছবি ওঠাও বিচিত্র নয়। অতঃপর পুলিশি ঝামেলায় এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইটটি ক্যান্সেল হলে বাকিদের দেশে ফেরা আটকে যেত। উত্তরে বত্রিশ পাটি বার করে বললাম নবনীতা দেবসেনের " ট্রাকবাহনে ম্যাকমাহনে" পড়েছেন কি? উনি আমার ইন্সপিরেশন, না পড়ে থাকলে অনেক পিছিয়ে আছেন। মাত্র পঁয়তাল্লিশ বছর আগে ওই স্বপ্নটি উনি দেখিয়ে গেছেন। আমার কি দোষ?
একটা disclaimer দিয়ে রাখি। নবনীতা দেব সেন যা ১৯৭৭ সালে করেছিলেন, ২০২২ সেটা করা কিন্তু বেশ চাপের। অতএব নিজ নিজ দায়িত্বে।
ভালো থাকুন
ভালো রাখুন।