Bhramon Er Guto

 ভ্রমনের গুঁতো

আর যেখানে যাও না রে ভাই সপ্ত সাগর পার,
গরমের ছুটিতে নর্থ বেঙ্গল বা সিকিম যেওনা খবরদার।
ভ্রমণ স্মৃতি সর্বদাই সতত সুখের হয় না, তবে তিক্ত অভিজ্ঞতা ভ্রমনার্থীদের সমৃদ্ধ করে। অভিজ্ঞতা যদি খারাপ ও হয় " কিছুই যায় না ফেলা " ।
গরমের ছুটি পড়ার পর মনটা যদি হটাৎ পাহাড় পাহাড় করে তাহলে সেটা অবশ্যই জামিন অযোগ্য অপরাধ বলে আমার এইবারের উপলব্ধি। দোষ কিন্তু একা আমার নয় । আমার পাহাড়ী বন্ধুরা ভিন্ন আঙ্গিকে হোটেলের বারান্দা, ছাদ , বাগান ,যত্রতত্র থেকে কাঞ্চনদা কে বন্দী করে মুখপুস্তিকায় পোস্টায় যা আমার মত ভ্রমণ উন্মদাদের লোভী মনকে উতলা করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। এবং আমার এই ধরনের ইচ্ছেকে সম্মান জানিয়ে ভারতীয় রেল ব্যবস্থা এগিয়ে আসে। তবে ততকাল টিকিটই যে শেষ কথা নয় সেটা এবার হারে হারে টের পেয়েছি। তবে জীবনের কোনো পাওনাই বৃথা যায়না। কিছু না কিছু শিক্ষা বন্টন করেই থাকে।
ভিড় থাকে বলে চিরকালই গরম ও পুজোর ছুটিতে নর্থ বেঙ্গল ও সিকিম এড়িয়ে এসেছি। ভাবলাম গোটা দেশ ঘুরেছি, এত নিজের রাজ্য , বা প্রতিবেশী । কি এমন কঠিন কাজ? যদিও ফেসবুকের বিভিন্ন ট্রাভেল গ্রুপে ওই সময় গুলিতে এই দুটি জায়গার তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা পড়েছি তবু দীর্ঘদিন বেড়াবার অভিজ্ঞটা আমাকে একটু বেশিই আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছিল তাই ওই পথে পা বাড়িয়েছিলাম, তার ফলাফল জানাতে এই গরমের ছুটির মুল অভিজ্ঞতায় আসি।
তৎকালের করুণায় দার্জিলিং mail নির্দিষ্ট টাইমে পৌঁছবার পর স্টেশন থেকে SNT বাস স্ট্যান্ড যাবো বলে মনে করছি, আশপাশ থেকে শুনলাম ওখানে বাস নেই। Share জীপের অবস্থা আরো খারাপ তাই অনেকেই স্টেশনের জীপ স্ট্যান্ডে ফিরে আসছেন। তাই আমিও একটি গ্যাংটক গামী share জীপে চড়ে বসলাম। জানলাম ফ্রন্ট ও মিডিল সিটে বসলে 800
টাকা জনপ্রতি, পেছনের সিটে 700. অনেকেই এই অতিরিক্ত ভাড়া বৃদ্ধির জন্য প্রতিবাদ করলে তাকে পত্রপাঠ নেমে যাওয়ার হুংকার দেওয়া হচ্ছে অত্যন্ত রূঢ় ভাষায়। আমি একবার রিজার্ভ গাড়ির খবর নিতে গিয়ে জানলাম ছোট গাড়ি ছ হাজার টাকা। এই অতিরিক্ত ভাড়ায় সমস্ত জীপ গাড়ির ড্রাইভারদের মধ্যে অদ্ভুত ঐক্য লক্ষ্য করলাম। এত টুরিস্ট এর প্রতিবাদ সত্বেও তারা নিজেদের সিদ্ধান্তে অটল।
ওদিকে বাসের আকাল এই অবস্থাকে আরও জোরদার করেছে। Share জীপ ও রিজার্ভ জিপের ভাড়া প্রতি ঘণ্টায় বাড়ছে। এরই মধ্যে একটু কালিম্পং এর সাতজন যাত্রীর একটি দল আসতেই জীপ থেকে সকলকে নেমে যাওয়ার আদেশ দেওয়া হলো এবং সেই গাড়িটি কালিম্পং অভিমুখে যাত্রা করলো। জানালো হলো এই গাড়ি যাবেনা অন্য গাড়ির ব্যবস্থা হচ্ছে। এর মধ্যে গ্যাংটক যাওয়ার রিজার্ভ গাড়ির রেট বেড়ে দাঁড়ালো সাত হাজার। সিন্ডিকেটের এক মাতব্বর এসে জানালো পুলিশ ধরলে যেনো পাঁচশো টাকা ভাড়া বলা হয় না হলে শাস্তি স্বরূপ সেই যাত্রীকে মাঝপথে নামিয়ে দেওয়া হবে। এরপর দশ জন যাত্রীকে ঠেসে নিয়ে তিনঘন্টা পর জীপ ছাড়লো। মুশকিল হলো এই ভীষণ ঔদ্ধত্য যারা দেখাচ্ছে তারা প্রত্যেকেই বাঙালী। মনে হচ্ছে আজই পৃথিবীর শেষ দিন। সব লুটেপুটে নেওয়ার এহেন সেরা সময় বোধহয় আর পাওয়া যাবেনা তাই বদ হজমের তোয়াক্কা না করে অবাধ লুটপাট চললো। গাড়ি ছাড়ার আগে সব ভাড়া বুঝে নেওয়া হলো আর তারপর শুরু হলো সিন্ডিকেট, দালাল, ও ড্রাইভারের মধ্যে টাকা পয়সার ভাগ নিয়ে তর্কাতর্কি। এখানেই শেষ নয়। জিপ স্ট্যান্ড থেকে হোটেলে যাওয়ার স্থানীয় তাক্সির ভাড়াও আকাশ ছুঁয়ে ফেলেছে।
এই ব্যাবসায় কোনো ইনভেস্টমেন্ট , শিক্ষা বা যোগ্যতার প্রয়োজন পড়েনা। শুধুমাত্র দাদাগিরি আর দুর্ব্যবহার করতে জানলেই এই পথ দিয়ে রোজগার শুরু করা যায়। এক দিকে প্রকৃতি উজাড় করে দিয়েছে তার সৌন্দর্য আর কিছু যোগ্যতাহীন মানুষ সেই আশীর্বাদ নিজের সম্পত্তি মনে করে বিক্রি করে চলেছে রং বেরংয়ের মোড়কে।
এত গেলো রাজ্যের কথা। সিকিমের মানুষজন অবশ্য ঔদ্ধত্য দেখায় না। তারা ঠান্ডা মাথায় প্যাকেজ বিক্রি করে। নর্থ সিকিমের দু রাত তিনদিনের প্যাকেজ কেউ পাচ্ছে চার হাজারে, কেউ সাড়ে পাঁচ, কেউ বা সাড়ে ছয়। ইয়ামথাং, gurudongmar share প্যাকেজ একই গাড়ি, একই হোটেল, একই খাবার কিন্তু প্যাকেজ মূল্য আলাদা আলাদা। যাকে যেমন বধ করা যাচ্ছে।
প্যাকেজ টুর করতে গিয়ে বোঝা যায়না আমরা দৌড়াচ্ছি না বেড়াচ্ছি। জিজ্ঞাসা করলে মিষ্টি হেসে ড্রাইভার ভাইয়ের উত্তর যেকোনো সময় ল্যান্ড স্লাইড হতে পারে তাই এই দৌড়। গাড়ি যখন চলে তখন রোলার কোস্টারের অনুভূতি আসে। কিন্তু যখন থামে সে যেনো আর চলতেই চায় না। পুরোটাই উদ্ধত ড্রাইভারের মর্জি।ছবি তোলার জন্য দু মিনিট গাড়ি দাড় করাবার অনুরোধ করলে আবার সেই মিষ্টি হেসে রিজার্ভ গাড়ি নেওয়ার পরামর্শ দেন ড্রাইভার ভাই। বেড়াতে এসেছি না চোর দায় ধরা পড়েছি বোঝা যায়না।
খাওয়ার অবস্থাও তদ্রুপ। হোটেলে গরম জ্বল থেকে টাওয়েল, সাবান সব কিছুই দুর্লভ। টাকা যেহেতু আগেই তারা হস্তগত করেছে তাই এইক্ষেত্রে তর্ক করাও মূর্খামি।গত তিনবছর যেই টুরিজম শিল্প ধুঁক ছিল, খেতে না পেয়ে মরতে বসেছিল তারাই আবার স্বস্থানে ফিরে রক্ত চক্ষু দেখায়। তিন বছরের খিদে জমে যেনো এল ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছে।আমাদের অতিরিক্ত নর্থ বেঙ্গল আর সিকিম প্রীতিকেই এই অবস্থার জন্য দায়ী বলে মনে হয়। বেশী না, মাত্র একমাস যদি এই দুটি স্থানকে বয়কট করা যায় তাহলেই বোধহয় এদের অনেক সংশোধন করা সম্ভব। তবে এর মধ্যেও কিছু হোম স্টে মালিক ও ড্রাইভার ভাইদের আন্তরিকতা মন ছুঁয়ে যায়।
টুরিস্টদের এই তিক্ততার সমাধানে এগিয়ে আসে স্বয়ং প্রকৃতি। তার উজাড় করা সৌন্দর্য দগদগে ঘায়ে মলমের কাজ করে। একই টুরে স্নো ফল, কাঞ্চনজঙ্ঘা, রৌদ্রজ্জ্বল সকাল , বৃষ্টিস্নাত সূর্যাস্ত, মায়াবী রাত, খরস্রোতা নদী গর্জন, উচ্ছল ঝর্না রঙিন রডোডেনড্রন অত্যন্ত মনোরম হওয়ায় সব দুঃখকে ভুলিয়ে দেয়। মনে ভাবি , প্রকৃতি মা নিজের সবটুকু বিলিয়ে দিয়েও তার সন্তানদের তুষ্ট করতে পারেনা, বিভিন্ন ভাবে বিক্রি হতে হয় তাকেও।
ট্রেন থেকে নেমেই যে তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলাম গাড়ি সেবক পেরোতেই ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠি। দীর্ঘদিন বেড়াবার সুবাদে পাহাড়ের বন্ধু বান্ধবের সংখ্যা প্রচুর তাই আশ্রয় খুঁজতেও অসুবিধা হয় না তবে বৃষ্টি ভেজা গ্যাংটককে অষ্টমীর সন্ধ্যার দেশপ্রিয় পার্ক বলে ভ্রম হয়। একটু বেশি পয়সায় নর্থ সিকিম টুর বুক করতে হয় বটে তবে লাচুং, লাচেনের বন্য সৌন্দর্য সব ভুলিয়ে দেয়। ম্যাজিকাল গুরদংমার, বিস্তৃত সবুজ ইয়ামথাং valley, রক্তিম রডোডেনড্রনের মেলা, কালাপাথথর এ বরফ স্নান, ছবির মত লাচুং গ্রাম পকেটর কষ্ট ভুলিয়ে দিতে সমর্থ হয়। এছাড়া বর্ষার জ্বলে পূর্ণ খরস্রোতা নদীগুলি দুর্দান্ত রূপধারণ মন ভুলিয়ে দেয় আর যা না বললেই নয় লাচুং ও লাচেন যাওয়ার পথের প্রত্যেকটি ঝর্না বিশেষ করে নাগা ফলস ভয়ঙ্কর সুন্দর হয়ে রাস্তার ওপর এমন ভাবে আছড়ে পড়েছিল যে গাড়ি চলা দায় হয়ে উঠেছিল, তাদের গর্জনও বহুদূর থেকে শোনা যায়। আমি ফিরে আসার কিছুদিন পরেই অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে নর্থ সিকিম টুর বন্ধ হয়ে যায়। তৎকালে যাওয়ার টিকিট পেলেও ফেরার টিকিট দুর্লভ হওয়ায় নগদ 2500 টাকায় গ্রিন লাইনের বাসে কলকাতা ফিরতে হয় ।।
ভালো থাকুন।
ভালো রাখুন।







Previous Post Next Post

Contact Form